
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টম ও ভ্যাট প্রশাসনে পদায়ন এখন গুটিকয় কর্মকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সিপাহি থেকে শুরু করে কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার বা সহকারী কমিশনার— কে কোন দপ্তরে থাকবেন, তা নির্ধারণ করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। অথচ নিয়ম অনুযায়ী পদায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের। কিন্তু বাস্তবে এনবিআরের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিজেদের বলয়ের বাইরে কাউকে সুযোগ না দিয়ে নিজেদের ঘনিষ্ঠদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন।
এনবিআরের ভেতরের সূত্র জানায়, নতুন প্রশাসনে সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তিনি আগে থেকেই পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। প্রশাসনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই মোয়াজ্জেম নিজের বলয় তৈরি করতে সচেষ্ট হন। আন্দোলনের সময় এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব আমীমুল ইহসানকে সরিয়ে তার ঘনিষ্ঠ ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুল ইসলামকে সেখানে বসান।
আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঢাকায় দায়িত্বে থাকাকালীন নানা অভিযোগ উঠলেও পরে তাকেই এনবিআরের প্রশাসনে নিয়ে আসা হয়। এখান থেকেই শুরু হয় কর্মকর্তাদের ব্যাপক বদলির প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় সচিব থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নিজেদের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা নিরাপদে থাকেন— এমন অভিযোগও রয়েছে।
এমনকি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমানের মতো কর্মকর্তারা, যাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, তারাও বলয়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে থাকেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আন্দোলনের কারণে কমিশনারকে বরখাস্ত করা হলেও মারুফ আরও ভালো পোস্টিং পান। যদিও সম্প্রতি চাপের মুখে তাকে সেখান থেকে সরানো হয়েছে।
এনবিআরের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন এ বিষয়ে বলেন, দ্বিতীয় সচিবকে বদলি করা হয়েছে অফিসের গোপনীয়তা না মানায়। কিন্তু কর্মকর্তারা বলছেন, এটি আসলে তার নিজের বলয় শক্ত করার কৌশল।
তদন্তে জানা গেছে, শুধু আরিফুল বা মারুফ নন, মোয়াজ্জেম তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল এবং বন্ড কমিশনারেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়ও বসিয়েছেন। এমনকি সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের চাচাতো ভাইকেও শুল্ক গোয়েন্দার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যেসব কর্মকর্তা এই বলয়ের অংশ নন, তাদের অনেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করা হয়েছে। এতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা তৈরি হয়েছে।
এনবিআরের পদায়ন নীতিমালায় কাস্টম ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের জন্য চারটি ক্যাটাগরি— ক, খ, গ ও ঘ— নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে ‘ক’ ও ‘খ’ ক্যাটাগরি মূল দপ্তর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত, আর ‘ঘ’ ক্যাটাগরি তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ও দূরবর্তী পোস্টিংয়ের জন্য। নীতিমালা অনুযায়ী, কাউকে ‘ক’ থেকে ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে পাঠানো সাধারণত শাস্তিমূলক পদায়ন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে এই নীতিমালা মানা হচ্ছে না।
ফলে এনবিআরের কাস্টম-ভ্যাট প্রশাসনে এখন ন্যায্য পদায়নের বদলে চলছে বলয়নির্ভর সিন্ডিকেটের দাপট। এতে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে।