
বিশেষ প্রতিবেদকঃ পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার পারসিধাই গ্রামের শিমুল একসময় ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পাবনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর ডিপ্লোমা করে ঢাকায় চাকরি শুরু করলেও ছোট আয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। বড় কিছু করার প্রত্যাশায় ২০১৮ সালে চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে বাণিজ্যিকভাবে হাঁস পালনের খামার শুরু করেন। কিন্তু সফলতা না আসায় ১৮ লাখ টাকার বিশাল লোকসানে ঋণের ভারে নুয়ে পড়েন তিনি।
ইউটিউব থেকে শুরু, সফল উদ্যোক্তা এখন শিমুল
একসময় হতাশাগ্রস্ত শিমুল হঠাৎ ইউটিউবে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই (BSF)’ নামে একটি পোকার চাষের ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পিসিডি (Program for Community Development) থেকে চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ নেন। পিসিডি তাকে ঋণ, প্রযুক্তি ও বাজার সংযুক্ততায় সহায়তা করে।
এখন তিনটি খামারের মালিক, মাসিক আয় প্রায় ২ লাখ
মাত্র ৩ বছরের মধ্যে শিমুল পোকা চাষে অনুকরণীয় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। ১৬ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করার পাশাপাশি কক্সবাজার ও পাবনায় তিনটি খামারের মালিক হয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় ২ লাখ টাকা। কক্সবাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগে বড় আকারে একটি ফার্মও গড়ে তুলেছেন।
কীভাবে চাষ হয় এই পোকা?
শিমুল জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের শক্ত খোলসযুক্ত পোকাগুলো জালের মধ্যে রেখে আলো-বাতাসে প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়। কাঠের স্তরে ডিম পাড়ে তারা, যা ৮-১০ দিন পর লার্ভায় রূপ নেয়। ২০-৩০ দিন পর লার্ভা পোকার রূপ নেয় এবং মাছ, হাঁস বা মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই লার্ভা মুরগির নাড়িভুড়ি, পচা খাবার কিংবা মাছ দিয়ে খাওয়ানো হয়।
দেশেই তৈরি হচ্ছে নতুন বাজার
শিমুল ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের মাদার পোকা রপ্তানি করছেন। এছাড়াও স্থানীয় ও ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছেও বিক্রি করেন এই পোকা। তার সফলতা দেখে পাবনায় বাড়ছে পোকা চাষের খামারের সংখ্যা।
বাজার, পুষ্টিমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ২৫ জেলায় প্রায় ২৮০ জন উদ্যোক্তা এই পোকা চাষে জড়িত। তারা মাসে ৭০ টনের বেশি পোকা উৎপাদন করছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল জানান, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ে ৪৩-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন থাকে, যেখানে প্রচলিত মাছ বা পোল্ট্রি খাদ্যে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। এতে খামারিদের খরচ কমে, উৎপাদন বাড়ে।
শুরুতে উপহাস, এখন অনুকরণীয়
শিমুল বলেন,“শুরুতে সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করত, কেউ কেউ ঘৃণাও করত। আজ সেই পোকা চাষই বদলে দিয়েছে জীবন। ধৈর্য ও পরিশ্রম থাকলে সফলতা আসবেই।”
পিসিডির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
পিসিডির নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল আলম বলেন,“শুরু থেকেই আমরা শিমুলের পাশে ছিলাম। প্রশিক্ষণ, ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেছি। আজ সে দেশসেরা উদ্যোক্তা।”
পোল্ট্রি ও ফিশারিজ খাতে সম্ভাবনার নাম ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই
বায়োটেকনোলজি, সার ও প্রাণিখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই পরিবেশবান্ধব এবং খরচসাশ্রয়ী। পোল্ট্রি ও মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পোকা আগামীতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে।