
নিজস্ব প্রতিবেদনঃ ‘বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার সম্পর্কে যে ভয়, কুসংস্কার ও ভুল ধারণা ছিল, তা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছে—ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়।’
এমন কথাই বললেন ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট।
অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজির উদ্যোগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয় এক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান, যার শিরোনাম ছিল ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’। আলোচনা পর্বটি উপস্থাপনা করেন নাসিহা তাহসিন এবং সরাসরি সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানে ডা. নওশিন বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক রোগী আসেন বুকে ব্যথা নিয়ে, কিন্তু সেসব ক্যানসার নয়। আবার যাঁদের সত্যিই ক্যানসার, তাঁদের অনেকের কোনো ব্যথাই থাকে না।’
তিনি জানান, বুকে ব্যথা মানেই ক্যানসার নয়, আবার ব্যথা না থাকলেও ক্যানসার থাকতে পারে—এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সময়মতো পরীক্ষা করানো খুব জরুরি।
স্তন ক্যানসারের কারণ ও ঝুঁকি
অনুষ্ঠানে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন জানান, স্তন ক্যানসার সব সময় বংশগত হয় না। মাত্র ১০–১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক ইতিহাস দায়ী। বাকি ৮৫ শতাংশ ক্যানসারের জন্য দায়ী আমাদের বর্তমান জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় কোনো উপসর্গ না-থাকলেও স্তনে চাকা অনুভব করা গেলে তা সতর্ক হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। রোগী যেন দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেন।
হরমোন ওষুধ ও স্তন ক্যানসারের সম্পর্ক
অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল বা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ব্যবহার করেন। এসব হরমোন-নির্ভর ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণ করলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। তবে স্বল্পমেয়াদি ব্যবহারে তেমন ঝুঁকি থাকে না।
স্ক্রিনিং কখন শুরু করবেন?
ডা. নওশিন বলেন,‘৪০ বছর বয়সের পর প্রতিটি নারীর নিয়মিত স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত।
আর পরিবারের কারও স্তন ক্যানসার থাকলে স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে আরও ১০ বছর আগে।’
৪০ বছরের নিচে নারীদের জন্য আলট্রাসাউন্ড এবং ৪০ বছরের ওপরের নারীদের জন্য ম্যামোগ্রাম সবচেয়ে উপযোগী স্ক্রিনিং পদ্ধতি বলেও জানান তিনি।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও নতুন থেরাপি
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় এখন শুধু সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি-তেই সীমাবদ্ধ নয়। যোগ হয়েছে টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি, যা রোগীর হরমোন রিসেপ্টর ও জেনেটিক প্রোফাইল অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
কেমোথেরাপির সময় চুল পড়া, শারীরিক দুর্বলতা ও মানসিক চাপ থাকলেও রোগীদের আশ্বস্ত করে ডা. নওশিন বলেন,‘এগুলো সাময়িক সমস্যা। কেমোথেরাপি শেষ হলে চুল আবার গজায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগটি নিরাময়যোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ব্যায়াম ক্যানসার রোগীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০–৩০ মিনিট হাঁটা এবং হাতের ব্যায়াম চালিয়ে যেতে হবে।
রোগীর বাস্তব অভিজ্ঞতা: শামীমা আক্তার
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নরসিংদীর স্তন ক্যানসার আক্রান্ত শামীমা আক্তার, যিনি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।
তিনি জানান, প্রথমে টিউমার ধরা পড়ে। বহু হাসপাতালে ঘোরাঘুরির পর জানতে পারেন, এটি ব্রেস্ট ক্যানসার। পরে আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন।
অপারেশনের পর তিনি ৮টি কেমোথেরাপি ও ১৫টি রেডিওথেরাপি নেন।‘প্রথম দিকে কেমো নিতে কষ্ট হতো। চুল পড়ে, দুর্বল লাগত। কিন্তু চিকিৎসা শেষ করে এখন আমি অনেকটাই সুস্থ।’— বলেন শামীমা।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ক্যানসার বিষয়ে ভীতি, কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা দূর করে সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণই পারে জীবন বাঁচাতে।
সচেতনতা, নিয়মিত স্ক্রিনিং, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে স্তন ক্যানসার এখন মোকাবিলা করা সম্ভব।