
শাহিন জামানঃ ভালোবাসার কাহিনি সাধারণত মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়—শাহজাহানের তাজমহল থেকে লাইলী-মজনু কিংবা শিরি-ফরহাদ, ইতিহাসে এমন উদাহরণ অজস্র। কিন্তু শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ–৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম আতিক ভালোবাসাকে ব্যবহার করেছেন অন্যভাবে। স্ত্রীকে খুশি করতে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আর সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের অধিদপ্তরের ভেতরেই কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন বছরের পর বছর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের যাদুপুর শিমুলতলা গ্রামের সন্তান আতিক ২০০৫ সালে বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাশ করে ২০০৮ সালে ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে গণপূর্তে যোগ দেন। চাকরিজীবনের প্রায় পুরোটাই তিনি কাটিয়েছেন রাজধানীর কেন্দ্রীয় দপ্তরগুলোতে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন শেরে বাংলা নগর গণপূর্তে, এরপর ২০১৮ সালে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে—যেখানে শেখ রেহানার বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। সেসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে তিনি হয়ে ওঠেন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আস্থাভাজন প্রকৌশলী।
২০০৮ সালে স্ত্রী কানিজা মুস্তারিনা ও বন্ধু জাহিদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে আতিক গড়ে তোলেন “Adroit Consultants & Engineers” নামের প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে চারজন পার্টনার থাকলেও ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কানিজা মুস্তারিনা ও জাহিদুর রহমানই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মালিক হয়ে যান। তবে সব ধরনের সরকারি কাগজপত্রে স্ত্রীর নাম আড়াল করে রাখেন আতিক—টিআইএন, ট্রেড লাইসেন্স, এনলিস্টমেন্ট—সবকিছুতেই ব্যবহৃত হয় অন্য তথ্য। এভাবেই সরকারি চাকরির নিয়ম ভেঙে নিজ স্ত্রীর নামে চালিয়ে যান ঠিকাদারি ব্যবসা।
সরকারি e-GP পোর্টালের তথ্য বলছে, “Adroit Consultants & Engineers” এককভাবে পেয়েছে ১৬৭টি কাজ, যার বেশিরভাগই নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগ ও ইএম বিভাগ–৯ থেকে। এই দুই বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীরা প্রায় সবাই “আতিক সিন্ডিকেটের” সদস্য হিসেবে পরিচিত। তার নির্দেশ অমান্য করলে বদলির ভয় থাকায় অনেকে বাধ্য হয়েই তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ দেন।
ইজিপি পোর্টালের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ফার্মটি পেয়েছে প্রায় ১৬৯টি কাজ, যার চুক্তিমূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা, আর মোট প্রকল্পমূল্য প্রায় ৭৩.৮২ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রকৌশলীর মাধ্যমে কাজের বণ্টনও ছিল পরিকল্পিত—জাকির ৩৬টি, হেলাল ৬১টি, শাহ আলম ফারুক ৪টি, ফজলুল হক ৫টি, আহসান হাবিব ৬টি, জুবায়ের বিন হায়দার ২৩টি ইত্যাদি। এর মধ্যে ১৩২টি কাজই দেওয়া হয়েছে একক দরদাতার মাধ্যমে, যা পিপিআরের নিয়ম লঙ্ঘন করে। যৌথভাবে পাওয়া সাতটি কাজের মূল্যই প্রায় ৬৫ কোটি টাকা—অর্থাৎ মোট প্রায় ১৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এই ফার্মের অনুকূলে গেছে।
২০২৫ সালের মার্চে নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন আহ্বান করেন ৫টি LTM ও ১টি OTM দরপত্র (টেন্ডার আইডি 1085367–1085371, 1085781)। আশ্চর্যজনকভাবে সবগুলো কাজই পেয়েছে “Adroit Consultants & Engineers”। ২০২৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে টেন্ডার আইডি 1042296, 1042341, 1042306, 1057127, 1055310, 1063680, 1063684, 1065001—এই আটটি কাজও এককভাবে তাদের নামে অনুমোদন পায়, যার মূল্য প্রায় ৭৬.১৭ লাখ টাকা।
গণপূর্তের ভেতরে এই সিন্ডিকেটের মূল সহযোদ্ধা হিসেবে আছেন হারুন অর রশিদ—সাবেক বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ বিভাগের এক্সেন। তাকে আনা হয় “বৈষম্যের শিকার” কর্মকর্তা হিসেবে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল আতিকের ফার্মের জন্য কোটি টাকার কাজ নিশ্চিত করা। গত ১১ মাসে তিনি একাই ২১টি কাজের মাধ্যমে প্রায় ১০.৬৬ কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন “Adroit” ও “ACE-AT JV” এর নামে।
এই সিন্ডিকেটকে ছত্রছায়া দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের বিরুদ্ধেও। অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা বলছেন, যতদিন আতিক ও তার সহযোগীরা বহাল থাকবেন, ততদিন গণপূর্ত অধিদপ্তর পরিশুদ্ধ হবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিজের স্ত্রীকে ঠিকাদার বানিয়ে কাজ করানো ক্ষমতার স্পষ্ট অপব্যবহার। এটি শুধু অনৈতিক নয়, বহুমাত্রিক অপরাধ—এতে প্রতারণা, তথ্য গোপন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের বিষয় জড়িত। আতিক ও তার স্ত্রী উভয়কেই আইনের আওতায় আনা উচিত।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম আতিক বলেন, “আমি কিছুই জানি না। আমার স্ত্রীর নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না, তাও জানি না।”
তবে গণপূর্তের ভেতরের অনেক কর্মকর্তা হতাশ কণ্ঠে বলছেন, “যত প্রমাণই আসুক, যত প্রতিবেদনই বের হোক—ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আতিক সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটাই গভীর যে, বদলি, নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য—সবই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।”
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে—গণপূর্ত অধিদপ্তর কি কখনোই শুদ্ধ হবে না? নাকি আতিকদের এই দাপট চলতেই থাকবে সরকারি অর্থ আর জনসম্পদের ওপর?