
এসএম বদরুল আলমঃ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়, তবে জোন–৫/২ এর অথরাইজড অফিসার মো. ইলিয়াস হোসেন যেন এই অনিয়মকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সরকারের পরিবর্তন ও শুদ্ধি অভিযানের প্রতিশ্রুতির পরও রাজউকের ভেতরের দুর্নীতি আগের মতোই বহাল রয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ রাজউকের উচ্চপর্যায় বিষয়টি জানলেও রহস্যজনক নীরবতাই পালন করা হচ্ছে।
রাজউক জোন–৫/২ এলাকা রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তেজগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ, নিউ মার্কেট, হাজারীবাগ থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চলছে ভবন নির্মাণ, নকশা জালিয়াতি ও দখল বাণিজ্য। অভিযোগ উঠেছে, এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে মূল ভূমিকায় আছেন অথরাইজড অফিসার ইলিয়াস। ভবন অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়া, অবৈধ নির্মাণের নোটিশ গায়েব করে দেওয়া এবং নিয়মভঙ্গকারীদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের লেনদেন—সবই এখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে ফার্মগেট তেজতুরি বাজার এলাকায় দুটি অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা পড়ে। অথচ ইলিয়াস প্রথমে দাবি করেন, ওই এলাকা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। পরে বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার চিঠি পাঠানো হলেও কোনো অভিযান হয়নি। অনুসন্ধানে উঠে আসে, সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে ভবনগুলো এখনো বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, পূর্ব রাজাবাজারের হোল্ডিং নম্বর ১৩১/১–এ ৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে নোটিশ দেওয়া হলেও আট মাস পার হয়ে গেলেও তা কার্যকর হয়নি। স্থানীয় সূত্র জানায়, অর্থের বিনিময়ে ফাইল চাপা পড়ে আছে। এমনকি কলাবাগানের একটি ভবনের নোটিশ ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ‘উধাও’ হয়ে গেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ধরনের অনিয়ম শুধু নোটিশ বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ল্যাবরেটরি রোডে অনুমোদিত নকশা অমান্য করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে গত বছর অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায় এবং তদন্তে জানা যায়—ইলিয়াসের সঙ্গে সেখানে ৩৫ লাখ টাকার সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশ, আইন বা শৃঙ্খলা এখানে টাকার কাছে অসহায়।
আরও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ রয়েছে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে। অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি নিজের ছোট ভাইকে ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ বানিয়ে পুরো দুর্নীতির নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন। রাজউকের কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী থাকার কোনো নিয়ম নেই। তারপরও তাঁর ভাই মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ভবন মালিকদের আর্থিক লেনদেন, নোটিশের কপি পৌঁছে দেওয়া এবং অবৈধ সমঝোতার যোগাযোগ রক্ষা—সবকিছুই নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাতিরপুল, নিউ মার্কেট, হাজারীবাগসহ বেশ কিছু এলাকায় নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। স্থানীয়ভাবে এটি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও, রাজউকের ভেতরের প্রভাবশালী একটি অংশ তাঁকে রক্ষা করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইলিয়াস সব অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে বলেন—“কাজের চাপ বেশি, স্টাফ কম, বাইক পর্যন্ত নেই।” তাঁর এই যুক্তি অনেকের কাছে শুধুই নাটকীয় আত্মপক্ষ সমর্থন বলে মনে হয়েছে।
এদিকে জোন–৫ এর পরিচালক মো. হামিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—প্রতিদিনের মতো অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, নথিপত্র ও তথ্য প্রকাশের পরও কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না? তাহলে কি রাজউকের ভেতরেই আছে কোনো প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা এ ধরনের দুর্নীতিকে ছত্রছায়া দিচ্ছে?
রাজউককে ঘিরে তৈরি হওয়া এই দুর্নীতির সাম্রাজ্য শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেই নয়—পুরো নগর প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজধানীতে নকশাবিহীন ভবন, লুটপাট, টাকার বিনিময়ে আইন বিক্রির ঘটনা আজ আর গুজব নয়, বরং প্রমাণিত বাস্তবতা।
এই দুর্নীতির চক্র কারা পরিচালনা করছে? বছরে কত কোটি টাকা হাতবদল হয় নোটিশ বাণিজ্যের নামে? কারা ইলিয়াসকে রক্ষা করছে রাজউকের ভেতর থেকে?—এ প্রশ্নের উত্তর এখন ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের।