
এসএম বদরুল আলমঃ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বৃহৎ প্রকল্প ‘রেজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (RUTDP)’–এর সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মোঃ মঞ্জুর আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঘুষ ও আত্মীয়করণ এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের প্রতিবেদনে তার নিয়োগ ও সম্পদ নিয়ে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছিল, তার পর এলজিইডির ভেতর ও বাইরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এবার প্রকাশিত হচ্ছে তৃতীয় পর্ব—যেখানে উঠে এসেছে তার অবসর (পি-আর-এল)–পরবর্তী সময়েও চলমান দুর্নীতির নতুন তথ্য।
গত ১১ অক্টোবর মোঃ মঞ্জুর আলী পি-আর-এল-এ যান, একই দিনে তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান এবং তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হন। তবে বিদায়ের আগ মুহূর্তেও তিনি থামেননি। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পি-আর-এলে যাওয়ার আগের দুই দিন—১৪ ও ১৫ অক্টোবর—তিনি রাত পর্যন্ত এলজিইডির প্রধান ভবনের চতুর্থ তলার সেমিনার কক্ষে বসে বহু ফাইল ব্যাকডেটে স্বাক্ষর করেন। এসব ফাইলের মধ্যে ছিল বিভিন্ন পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রকল্প বরাদ্দের অনুমোদন, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১,১১২ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এই বরাদ্দের বিপরীতে তিনি পৌরসভা ও কনসালটেন্টদের কাছ থেকে ৫% হারে ঘুষ নিয়েছেন।
সূত্রমতে, যেসব পৌরসভা পিডির শর্তে রাজি হয়, কেবল তারাই বরাদ্দ পায়। ফলে ৮১টি পৌরসভা ও ৬টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ৬৯টি বরাদ্দ পেলেও বাকি ১৮টি কোনো বরাদ্দ পায়নি। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে মঞ্জুর আলীর নিজ জেলা দিনাজপুরের পৌরসভাগুলো—দিনাজপুর সদর ৫৮ কোটি, বিরল ১১.৫ কোটি, বিরামপুর ১২.৫ কোটি ও বিরগঞ্জ পৌরসভা ৭.৫ কোটি টাকা। বগুড়া সদর পৌরসভায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫২ কোটি টাকা, আর নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভায় ৪৬ কোটি টাকা—যেখানে আগে ঘুষের বিনিময়ে বরাদ্দের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এবার তিনি প্রতিশোধস্বরূপ “ছপ্পর ভরে” বরাদ্দ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগের বেশ কয়েকটি পৌরসভায় অস্বাভাবিক পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে—যেমন মিরেশ্বরাই ২০ কোটি, পটিয়া ১৬ কোটি ৫০ লাখ, নোয়াখালী সদর ২১ কোটি ৫০ লাখ, কক্সবাজার ২৯ কোটি, ফেনী ২৯ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, এসব বরাদ্দের পেছনে চট্টগ্রামের এক ঠিকাদারের সঙ্গে মঞ্জুর আলীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন ছিল মূল কারণ।
অভিযোগ আরও আছে, পি-আর-এল-এ যাওয়ার আগে তিনি আত্মীয়স্বজনদের বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি দিয়েছেন। দিনাজপুর ও আশপাশের পৌরসভাগুলোর আউটসোর্সিং ও কনসালটেন্ট নিয়োগে তার ভাই, ভগ্নিপতি, ভাগ্নে এমনকি দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও যুক্ত ছিলেন। বদলি বাণিজ্যেও তার নাম উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় এই বদলি বাণিজ্য, যা পরে এলজিইডির ভেতরে “৩৬ আগস্ট” নামে পরিচিত হয়। প্রধান প্রকৌশলীর অনুপস্থিতির সুযোগে মঞ্জুর আলী ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে নেন। উপজেলা প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষকসহ বিভিন্ন পদে বদলির নামে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, আর্থিক স্বার্থে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। তার প্ররোচনায় এক কর্মকর্তাকে কর্মচারীরা লাঞ্ছিতও করে। মঞ্জুর আলীর এই প্রভাব-প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, প্রকল্পের অনুমোদন, বরাদ্দ বা বদলির কোনো সিদ্ধান্তই তার অনুমতি ছাড়া নেওয়া যেত না।
সবশেষে জানা গেছে, তিনি পি-আর-এল-এ গিয়েও প্রকল্পের ব্যাকডেটেড ফাইল স্বাক্ষর করে ঘুষ বাণিজ্য অব্যাহত রাখেন। তার ঘুষ, আত্মীয়করণ, এবং নিয়োগ–বদলির ব্যবসা এখন এলজিইডিতে মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কর্মকর্তারা বলছেন—“মঞ্জুর আলী চলে গেলেও রেখে গেছেন এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য, যেখানে ঘুষই নিয়ম, আর প্রকল্পই ব্যক্তিগত সম্পদ।”