
এসএম বদরুল আলমঃ গণপূর্ত অধিদপ্তরের মহাখালী বিভাগে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়জুল ইসলাম ডিউক— যিনি ক্ষমতার ছায়ায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার ঘুষ ও কমিশন নিয়ে কাজ পাইয়ে দিচ্ছেন এবং বিল ছাড়ের সময়ও বড় অঙ্কের কমিশন নিচ্ছেন।
বিগত সরকার আমলে তিনি দলীয় ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের আশ্রয় দিয়ে একপ্রকার কমিশন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। ঠিকাদারদের অভিযোগ, ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ না দিলে কোনো কাজ পাওয়া যায় না, এমনকি বিল ছাড়ও হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর মেরামতের কাজ তিনি দরপত্র আহ্বানের আগেই শুরু করার মৌখিক নির্দেশ দেন, পরে নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করান— আর বিনিময়ে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের কমিশন।
এছাড়া চলতি অর্থবছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাজ তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ওটিএম পদ্ধতিতে নিজস্ব ঠিকাদারদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গোপন কোটেশনের মাধ্যমে আরও অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও মিলেছে। অফিসের ভেতরে “কমিশন ছাড়া কাজ হয় না” এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাঁর আমলে।
মহাখালী গণপূর্তের কাজের মানও ভয়াবহভাবে নেমে গেছে। কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভবন, সেতু ভবনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে নিম্নমানের ইট, রড ও সিমেন্ট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কাজের মান তাতে প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি অসম্পূর্ণ কাজেরও অগ্রিম বিল ছাড় দেওয়া হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে।
সূত্র জানায়, ডিউক তাঁর ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের জন্য একটি বিশেষ “ভিআইপি তালিকা” তৈরি করেছেন— যেখানে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রায় নিয়মিতভাবে কাজ পাচ্ছে। অনিক ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, এনএল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, এবং খান এন্টারপ্রাইজ— এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সরকারি ভবন সংস্কারে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোটি টাকার কাজ পাচ্ছে।
অভিযোগ আছে, ডিউক “প্রক্সি টেন্ডার” পদ্ধতিতেও দুর্নীতির জাল বিস্তার করেছেন— যেখানে এক ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দিয়ে প্রতিযোগিতার ভান তৈরি করেন, কিন্তু সব কাজ শেষ পর্যন্ত যায় একই সিন্ডিকেটের হাতে। এতে প্রকৃত ঠিকাদাররা বঞ্চিত হচ্ছেন, আর কমিশনভিত্তিক এই চক্র ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সরকারি অর্থ।
এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিসে অনুপস্থিতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সহকর্মীরাও। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এসডিই ওয়াহিদ বিন ফরহাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে— কাজ পেতে হলে তাঁর কাছেও নগদ টাকা দিতে হয়।
সবশেষে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে মহাখালী গণপূর্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে। দুদকের কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী জানিয়েছেন, সরকারি অফিসগুলো দুর্নীতিমুক্ত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ, আর মহাখালী গণপূর্তের বিষয়ে একটি তদন্ত টিম কাজ করছে।
তবে এখনো তদন্ত শেষ না হওয়ায় কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসেনি। অন্যদিকে, অভিযোগের বিষয়ে ফয়জুল ইসলাম ডিউকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদাররা বলছেন, “এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো বিভাগের ভাবমূর্তি ধ্বংস হবে।”
ফলে এখন প্রশ্ন একটাই— দুদকের তদন্ত কতদূর যাবে, আর কতটা অদৃশ্য প্রভাবশালী শক্তি এই অভিযুক্ত প্রকৌশলীকে রক্ষা করবে? সময়ই তার উত্তর দেবে।